আমার দ্বিতীয় বই : গিৎচাম কাৎথা │ তর্পণ ঘাগ্রা │ খু•রাং

আমার দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেছি আনেকদিন পর, ২০১৯ সালে। বই ছাপানোর খরচ যোগাতে পরিনি তাই এত দেরি। বইটির নাম দিলাম ‘গিৎচাম কাৎথা’। নামটি গারো ভাষায় দেওয়া, বাংলায় ‘পুরনো কথা’। গারো বয়স্কদের কাছে জিজ্ঞেস করে লিখেছি। গারোদের পুরনো কথা পুরনো লোকদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে লিখেছি, তাই মিলাতে গিয়ে বইয়ের নাম দিলাম গিৎচাম কাৎথা। গারোদের নিজেদের সংস্কৃতি ইতিহাস ক’জন ছাড়া বেশির ভাগ গারোই জানে না, এ যুগের যুবক যুবতীরা তো আরো অনেক দুরের কথা। যারা জানে তারাও অনেক বয়স্ক ৮০ থেকে ৯০ বছর বয়সের। তারা মারা গেলে সব হারিয়ে যাবে, নিজেদের ইতিহাস সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সব দিক বিবেচনা করে, সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছি। হাজার বছরের চলে আসা গারো সংস্কৃতি এক জনের বলা, আরেক জনের বলার সাথে একটু অমিল হতেও পারে। গারোদের গোত্রভেদেও পার্থক্য থাকতে পারে। আমি যা লিখেছি, তার সাথে মিল নাও থাকতে পারে। তবে আমি আমার মতো লিখিনি, সব সংগ্রহ করেছি।

“গারোদের হিসেব সব সময় যুগের কথা বলে, মিৎদে মান্দেনি চাসং বা দেবতাদের যুগে পাঁচ গারো মহিলাকে মিৎদে স্বপ্নে উপাধি নিতে বলে। ১. রানজা মাকে সাংমা, ২. মাককাল মাকে মারাক, ৩. রাংমিন মাকে মমিন, ৪. দেদেং মাকে আরেং, ৫. নাদাং মাকে শিরা।”

গারোদের ইতিহাস সংস্কৃতি সম্পর্কে মেঘালয় গারো হিলসের গারো লেখকেরা অনেক বই লিখে ফেলেছে, যেন ডাবল না হয়, সেভাবে লিখতে চেষ্টা করেছি। এক সময় আমি বার বার ভিসা নিয়ে ভারত যেতাম, মেঘালয়ের রাজধানী শিলং লাইব্রেরী থেকে গারোদের সম্পর্কে লেখা অনেক বই কিনেছি। তুরা জেলা লাইব্রেরী থেকেও গারোদের বই কিনেছি। গারো লেখকদের সাথে কথা বলেছি, পরামর্শ চেয়েছি। প্রচুর স্টাডি করার পর আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছি, তারপরও মিল হয়ে যেতে পারে। যেমন গারোদের প্রধান উপাধিগুলো লেখা হয়ে গেছে। ‘গিমমা গিম্মিন আচিকরাংনি আ-দকরাং’ এ বইটি লিখেছেন গারো লেখক মিহির এন. সাংমা। এ বইয়ের ১৩ পৃষ্টায় লেখা আছে গারোদের পাঁচটি প্রধান উপাধির কথা, তিনিও সংগ্রহ করেই লিখেছেন। লেখা অনুযায়ী লিখে দিচ্ছি, গারোদের হিসেব সব সময় যুগের কথা বলে, মিৎদে মান্দেনি চাসং বা দেবতাদের যুগে পাঁচ গারো মহিলাকে মিৎদে স্বপ্নে উপাধি নিতে বলে। ১. রানজা মাকে সাংমা, ২. মাককাল মাকে মারাক, ৩. রাংমিন মাকে মমিন, ৪. দেদেং মাকে আরেং, ৫. নাদাং মাকে শিরা। এ পাঁচটির কথায় লেখা দেখলাম। আবার গারো লেখক দেওয়ান সিং রাংমতু অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ গারো লেখক বৃটিশ সময়েই বি.এ. অনার্স ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে বড় চাকুরি নিতে পারতেন কিন্ত তিনি লেখক হয়েছেন, হিসেবে অনেক বই লিখেছেন। বৃটিশ সরকার উনার জন্য টাইপ রাইটার দিয়েছিলেন আর মাসিক সন্মানি ভাতাও দিতেন। উনার বইয়ে সাংমা মারাক উপাধির এভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক গারো যুবক দাঁড়িয়ে ঘুমাতেন। তার মা বোনেরা তাকে বলে, তুমি কেন দাঁড়িয়ে ঘুমাও, আমাদের মত ঘুমাতে পার না? সে বলে, আমার জন্য সাং ঘর তৈরি করে দাও তবেই আমি তোমাদের মতো ঘুমাব, সাং বাংলা মাচাং ঘর, মা বোনেরা সবাই মিলে সাং ঘর তৈরি করে দেয়। পরে যুবক সাং ঘরে মা বোনদের মত ঘুমিয়ে ছিল, পরে সাং ঘরে যুবকের সাথে তার মা বোনেরাও থাকে। এ কারণে সাং ঘরে যতজন ছিল সবাইকে অন্য গারোরা সাংমা উপাধি দেয়, সাং ঘরে মায়েরা থেকেছে বলে সাংমা উপাধি হয়েছে। কখন এরকম ঘটেছে, গারোরা গারো ভাষায় বলে মাচাং চাৎচি চানকুজা, আইন কানুন খা-কুজা অর্থাৎ উপাধি সৃষ্টি হয়নি, আইন নিয়ম তৈরি হয়নি, সেই যুগের ঘটনা। মারাক উপাধিকেও তিনি এভাবে ব্যাখ্যা দেন, সেই সময়ে বিবাহের নিয়ম কানুনও বেশি নেই, কাছের আত্মীয় স্বজনকেও বিয়ে করে ফেলে। বহল যুবক তার সম্পর্কের বোন, যুবতী সুন্দরী দেখে বিয়ে করার চেষ্টা করে কিন্তু মানক এত শক্ত ছিল, কয়েক বছর চেষ্টা করেও বিবাহ করতে পারেনি। পরে বিবাহ করতে না পেয়ে সে গারো ভাষায় বলে মা-রাং রাকগা, সেখান থেকেই সেই যুবতীর বংশের লোকেরা মারাক উপাধি নেয়। গারোদের নাম দেখলে অনেকের কাছে প্রশ্ন জাগবে, যেমন রানজিংমা, জাপপা, হয়তো রানজিংয়ের মা বা জাপপের পিতা। কিন্ত বয়স্করা বলে না গারোদের মেয়েদের নামের পিছনে সব সময় মা থাকে, আর পুরুষের নামে পা থাকবে, যেন নাম শুনেই পুরুষ মহিলা বুঝতে পারে।
আমি চেষ্টা করেছি গিৎচাম কাৎথা বইয়ে যেগুলো লেখা হয়নি সেগুলো লিখতে, এখানে আমি প্রধান উপাধি লিখিনি। ছোট আরো যেসব উপাধি সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো সংগ্রহ করে লিখতে চেষ্টা করেছি, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছি। যেমন চিসিম উপাধি চি মানে বাংলায় পানি, সিম মানে সিমমা বা কালো যে ঘাটের পানি ব্যবহার করেছে, সেই পানি গভীর ছিল বলে সবসময় কালো দেখাত। সেই ঘাটের পানি যারা ব্যবহার করেছে তাদের সবাইকে চিসিম উপাধি দিয়েছে, আবার চিসিম থেকে কি কি উপাধি বের হয়েছে সেগুলো লিখলাম। বইটি সর্ব মোট ৯৪ পৃষ্ঠার। কিভাবে সূচিপত্র সাজালাম তাও নিচে লিখে দিলাম। মাচাং চাৎচি ছাড়াও আরো অন্য বিষয়গুলোও বইয়ে স্থান পেয়েছে।
১। গ্রীকগা, মিৎদে ওয়াইমং, আসং মিৎদে।
২।নক নাপবা বা ঘর উৎসর্গ, মিমাংকাম বা শ্রাদ্ধ, রানধী মিকচি গালচেংআ বা বিধবার কান্না, সিদিল চেংআ বা প্রথম মৃত্যু।
৩। গারো লোক সাহিত্য রেরে’র কথা, আজিয়া।
৪। নকরেক মাচং চাৎচি, আগিদক মাচং চাৎচি, চিসিম মাচং চাৎচি, রাংসা মাচং চাৎচি, ম্রং মাচং চাৎচি, বনোওয়ারী মাচং চাৎচি, মংমাওয়ারা বা হাতিওয়ারা, মানকিন মাচং চাৎচি, রংমা মাচং চাৎচি, নাপাক মাচং চাৎচি।
৫। গল্প দওপো বা পেঁচা, চাওকক বা চোর, চিপপু আরো কিসিং, মাৎচা আরো মেংগং।

সবই সংগ্রহ করে লেখা।

বইটি প্রকাশ করেছে দাকবেওয়াল। প্রচ্ছদ রিঙকু অনিমিখ। মূল্য ২৪০.০০ টাকা।

লেখকের অন্যান্য বই

মূল্য ২১০.০০ টাকা
মূল্য ৩৪০.০০ টাকা




Post a Comment

0 Comments