রংচুগাল্লা সম্পর্কে কিছু কথা ‖ ফিডেল ডি. সাংমা ‖ খু•রাং

আমার জীবনে প্রথম রংচুগাল্লা অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা : 

সংস্কৃতি, উৎসব কে-না ভালোবাসে? মানুষ বা যেকোন প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন হয় তেমনই মনেরও প্রয়োজন হয় সুখ, আনন্দ ও পরিতৃপ্তির। আর এ চাহিদা পূরণ করে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কৃতকর্ম এবং সামাজিক রীতি-নীতি।

পৃথিবী থেকে চমৎকৃত হওয়ার মতো সংস্কৃতি লালন ও পালনকারীদের বাছাই করতে হলে আদিবাসীদের নামই সর্ব প্রথমে আসা অধিক যুক্তিযুক্ত। এরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্ব-প্রণোদিতভাবে এবং আনন্দের সাথে বিভিন্ন সময় নিজস্ব উৎসবসমূহ পালন করে থাকে। 

গারোদের আদি ধর্মের নাম সাংসারেক। প্রাচীন ব্যাবিলন, গ্রীস, মিশর, চীন, পারস্য, রোমানদের মতো গারোরাও সূর্যদেবতার পূজো করত। গারোদের এ সূর্যদেবতার নাম মিসি সালজং। যার সম্মানার্থে ওয়ানগালা উৎসবসমূহ—সবগুলোই জুম চাষ কেন্দ্রীক। তাই চাষাবাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেবতাদের তুষ্টির জন্য, চাহিদা মাফিক রোদ বৃষ্টি বায়ু এবং পোকা-মাকড়ের রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য এ উৎসবগুলো পালন করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে একমাত্র ওয়ানগালা উৎসবই হচ্ছে আনন্দের অর্থাৎ ঘরে ফসল তোলার পরই এ উৎসব পালন করা হয়। এটি একটি নৈবেদ্যেৎসব ও নবান্ন উৎসব। এ-দিনে গ্রামের সকলেই সং নকমার বাড়িতে একত্র হয়ে গরু, শুকর, মোরগ দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। এ উৎসবের সময়কাল ৩ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। তাই গ্রামের সকলেই সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চু-খাজি খেয়ে নাচ-গানের মধ্য দিয়ে আমোদ করে থাকে। এ সময়ে যুবক-যুবতীদের জন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের কাজও চলতে থাকে। 

গারোদের উৎসবগুলো হলো— ১) দেন বিলসিয়া, ২) আসিরকা, ৩) আগালমাকা, ৪) রংচুগাল্লা, ৫) জামেগাপ্পা আবহাওয়া, ৬) ওয়ানগালা, ৭) দ.থাত্তা বা নকনি মিদ্দিনা হন্না, ৮) খ্রংনা দ.থাত্তা ইত্যাদি।

গারোদের উৎসবগুলোর মধ্যে ওয়ানগালাকে বড় উৎসব হিসেবে ধরা হলেও আজ আমি রংচুগাল্লা নিয়ে আলোচনা করব। রংচুগাল্লা ধান কাটার পূর্বে এবং ধান বা ফসলের জন্য বীজ সংগ্রহের পূর্বে আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের জন্য উক্ত জমির কিছু অংশ পরিস্কার করে সেখানে কলাপাতায় চিড়া, আখ/চিনি/গুড়, লেবু ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এ-সময় রাং বাজিয়ে আনন্দসহকারে নৃত্য পরিবেশন হয়। আর সময়কাল হলো আগস্ট মাস। 

জুম ক্ষেতে চাষ হওয়ার সময় থেকে গারোরা রংচুগাল্লার স্বপ্ন দেখতে থাকে। ‘রংচু’ শব্দের অর্থ চিড়া আর ‘গাল্লা’ শব্দের অর্থ ফেলা। অর্থাৎ রংচুগাল্লা হচ্ছে চিড়া ফেলার পূজো এবং আনন্দ উৎসব। রংচুগাল্লা উৎসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। পুরাতন কাজকর্ম, মনের পুরাতন ভাবনা, ধ্যান-ধারণার নবীনিকরণ এবং ধান বা অন্যান্য ফসলগুলো গোলায় তোলার আগে নতুন ফসল থেকে পরবর্তী বছরের জন্য উৎকৃষ্ট মানের বীজ বাছাই করে জমা রাখার শুভসূচনা। তাই জুম ক্ষেতের ধান কাটার সাথে সাথে রংচুগাল্লা উৎসবের আয়োজন করা হয়। 

গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক বিশ্বাসীদের মতে, জগৎ স্রষ্টা মিদ্দি আপফা তাতারা-রাবুগার পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে জগৎ জুড়ে পানি আর বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি পৃথিবীর আদি মানব- শানী আর মুনিকে প্রথমে সৃষ্টি করেন। শানি-মুনির বংশধর অর্থাৎ মানুষ শুরু থেকেই বনের ফল-মূল, লতা-পাতা এবং বনের পশু-পাখি শিকার করে জীবন ধারণ করত। পৃথিবীতে মানুষ বেড়ে যাওয়ায় একসময় মানুষের বসবাসের জন্য স্থান সংকুলান এবং বনের ফল-মূল পশু-পাখির অভাব দেখা দিতে লাগল। বাধ্য হয়ে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খাবার এবং বাসস্থানের সন্ধান করতে লাগল। কিন্তু নতুন জায়গাতেও বনের ফল-মূল, লতা-পাতা এবং বনের পশু-পাখি শিকার করে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হতো না। এভাবে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় সকলে মিলে স্রষ্টার কাছে তাদের কষ্টের কথা জানাল। শস্যদেবতা মিসি সালজং-এর দয়ায় মানুষ প্রথমে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাদ করতে শিখে নিল। যারা প্রথম চাষ করেছিল তাদের নাম বনজাসকো এবং তার স্ত্রীর নাম জানেগানদো। তাদের মাধ্যমেই গারোরা এবং পরবর্তীতে সকল মনুষ্যজাতি চাষাবাদ করতে থাকে। গারোদের বিশ্বাস, মানুষের শ্রমের ফসলগুলো দেবতারা নানা প্রকার দুর্বিপাক, পোকা-মাকড় ও জীব-জন্তুর হাত থেকে রক্ষা করেন। তাই দেবতাদের তুষ্ট করতেই এ রংচুগাল্লার আয়োজন। এভাবেই কামাল দীনেশ নকরেক জানালেন রংচুগাল্লার পৌরাণিক গল্পটি। আরো জানালেন, একদিন আওয়াত ফান্তি জেঙাত মিচিক জমি থেকে ধান তুলে বাড়িতে নিয়ে আসছিলেন, এমন সময় রাস্তায় সালমাগিচ্চাক নামে এক মানুষরূপী দেবী চিংজিবিমা বলসালেকি জেংমিও দেখা দিলেন। বললেন, তোমরা তো শস্যদেবী মা ফিলদির উপযুক্ত সম্মান না দিয়ে মারাত্মক অন্যায় করেছ (আইয়াও নাসঙো মারাং গাআহজক, আমা ফিলদিখো গিদ্দকগ্রি দাক্কেকজক, নাচিলগ্রি ফিল্লেতজন), যার দয়া করুণায় ফসল পেলে, তাঁকে স্মরণ না করে কিভাবে ঘরে তা তুলতে চাও? তাঁকে এভাবে অসম্মান করার জন্য আমার ফিলদিকে পূজো দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হবে (মারাং- কিপাতংকো ওয়াতনা নাংনাজক)। তখন আওয়াত ফান্তি জেঙাত মিচিক ভয়ে জানতে চাইলেন কিভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হবে? তখন দেবী জানালেন, নাআদে নরমান্দিদে, দিমাঙষিদে, মিকো সএসা, চুকো সংএসা মান্দে থম্মেসা, বলথং চিল্লেসা, আদুরি সিকবোনে, রাংখো দকবোনে, হিসাল আক্কেসা হিচুকো আন্নেসা, থিমাচু আওয়াককো চিনবোনে, মিরংচুকো হনবোনে- আফা মিদ্দেকো মিংএ, কাসাকো মানবোনে। চুবিচ্চিকো রুয়েসা, মারাংকো ওয়াতবোনে, মিমামিসিকো, বিলসিনা। বিৎচিরাংকো, নকগো গাতবোনে, জাম্মো দনবোনে। মারাং ওয়াতগিজাদে, কিপাথাং জাংগিজাদে, বানা ফেংএংনো, রিচ্চক সঙেংনো, মারা সক্কাংনো, কিপাথাং জান্নাংনো। আদক বাত্তিনো, চিবিল রোয়িনো, চিরিং চুওংনো, মারাং গাআংনো। আপফা নকচামী, আমা আংসারি, কাংনাবা নাসং, ওয়েনেংনাবা নাসং মারং হারোয়াম কিপাথাং জান্নোয়া। থাকরাক বিজাককো, হিসাল হিচুকো, আপফানা চিন্নেসা, মিদ্দেনা দান্নেসা গালবোনে, কিপাথাং ওয়াতবোনে অর্থাৎ ধান কাটার পরে গোলা ঘরে ফসল তোলার আগে তোমরা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করবে। তাঁকে পূজো দেবে। ঘরের ভেতর কলা পাতা বিছিয়ে সেখানে চাল, চিড়া, গুর, লেবু দেবে। তারপর চু বিচ্চি দিয়ে ফসলগুলোকে পবিত্র করে তারপর গোলায় ফসল তুলবে। এ পূজো না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা কেউ নতুন ফসল কাটবে না, নদীর ওপারে যেতে পারবে না, দূরের কোন গ্রামে যাবে না, গ্রামের কোন বিচার শালিস, আনন্দ উৎসব করা যাবে না। জানা যায়, আজও সাংসারেক গারোরা রংচুগাল্লা না হওয়া পর্যন্ত কেউ দূরে কোথাও বেড়াতে যায় না, নতুন আত্মীয়তা গড়ে না, এমনকি শালিস বিচার কার্য, আনন্দ উল্লাস করে না। তাই সাংসারেকদের মাঝে আজও রংচুগাল্লার আয়োজন করতে হয়। রংচুগাল্লা উৎসবের আয়োজনে সং নকমা ( গ্রাম নেতা) দাকগুরা (চকিদার) এবং মাদ্দক (কামালের সহকারী)কে দিয়ে সকলেই ধান কাটা সমাপ্ত করেছে কিনা তা জানতে এবং প্রতিটি পরিবারকে চুমানচি, চু তৈরী করার জন্য বলতে গ্রামের সবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর নতুন ধান কড়াইয়ে ভেজে রংচু বা চিড়া ভাজতে হয় যাকে গারো ভাষায় মিমারংচু বলা হয়। সবকিছু প্রস্তুত হয়ে গেলে সং নকমা রংচুগাল্লার অনুষ্ঠানের জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। শীঘ্রই গ্রামে সাজসাজ রব শুরু হয়ে যায়। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা, ঘরদোর হয়ে ওঠে ঝকঝকে পরিস্কার। সবার পরিবারে নতুন ধান, চিড়া এবং চু বিচ্চির মম গন্ধ। দামা, রাং, আদুরি, বেজে ওঠার প্রস্তুতি সমাপ্ত হলে প্রথমে সং নকমার ঘরের মাঝখানে দু’ভাগে (দংরামা, আর নকজাংচি) কচি কলা পাতা দিয়ে বেদী সাজানো হয়। তাতে নতুন ধানের চিড়া, চিনি বা গুড়, লেবু বা লেবুর পাতা ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য প্রস্তুত হয়ে গেলে কামালের নির্দেশে একসাথে দামা-বলথং, রাং, আদুরি, বেজে ওঠে। কামাল যথারীতি তাঁর পূজোর মন্ত্রপাঠ শুরু করে দেন। তারপর গ্রামের সবার বাড়ি গিয়ে একইভাবে পূজো পর্ব পালন করে।

এভাবে দামা-বলথং, রাং, আদুরির তালে তালে চু খাজি খেয়ে খেয়ে, রেরে আজিয়া গেয়ে গেয়ে রংচুগাল্লা উৎসব চলতে থাকে। এ বছরে যদি কারোর বাড়িতে নতুন খিম্মা এবং দেল্লাং থাকে সেখানে মিদং বাঁধা হয়। সবশেষে সং নকমার বাড়িতে দামা-বলথং পুনরায় গগাতার (রাখার) উদ্দেশ্যে বড় একটি ছাগল মেরে সবাইকে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে তিনদিন ব্যাপী রংচুগাল্লা উৎসবের পরিসমাপ্তি হয়। রংচুগাল্লা উৎসব আয়োজনের সময়কাল জামেদক জা অর্থাৎ আগস্ট মাস। রংচুগাল্লায় কামালের পূজোর মন্ত্র ইয়াহৈ... বানি মারিরাং, বানি, খিপাতাং, সালমাং গিচ্চাকনে, সালমাং দুরিনে আওয়াও রিওনবা, এরামা দিংজি বিমাও আওয়াতে পান্তিকো, জেঙাত মিচিককো, রামা দিংদিবিমাও, বলসালেকি দিমিও গেরং আরিমুং, নামসাংআরিমুং, মিবাল অল্লাকো, জাম নকগো গাত্তাকো হিওসা আগানচাকনা, হিওসা কুস্রকজকনা, মিমা রংচুকো, থিমাচু আওয়াককো হনবো চিনবোনে, হিচা গালবোনে, মারিরাং গালবোনে খিপাত্তাং ওয়াতবোনে। আফা মিদ্দেকো মিংবোনে, খাসাকো মানবোনে, উনাসা আঙাবা, কামাল রংজিফাবা নাংনা আন্নেঙা, নাংনা চিন্নেঙা। ইয়াহৈ...


ফিডেল ডি. সাংমা, কবি ও লেখক।

Post a Comment

0 Comments