ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধি ‖ তর্পণ ঘাগ্রা ‖ প্রথম পর্ব ‖ খু•রাং


ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধিকে বিভিন্ন জায়গায় স্থান কাল পাত্র বা গোত্র ভেদে বিভিন্ন নামে ডাকে, কেন এরকম নাম হলো, কি ইতিহাস আছে জিজ্ঞেস করলে ভাল সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে নি। বেশির ভাগ ঘাগ্রা বা তার দল মাচং চাৎচি উপাধির লোকেরা বলে আমাদের মা-বাবা দাদা-দাদি এরকম নিতে বা লিখতে বলেছে তাই আমরা নিচ্ছি, হয়ত জানা লোক থাকতে পারে। এই ঘাগ্রা উপাধির নাম ভিন্ন ভিন্ন নাম এরকম ১. ঘাগ্রা ২. গারা ৩. গানচি ৪. গারে ৫. গারাই ৬. গাবিল ৭ কাকড়া। হয়ত খুঁজলে আরো থাকতে পারে। ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধি কিভাবে আসছে বা তার অর্থ জিজ্ঞেস করলে এভাবে বলে গারো জাতির একটি গোত্র আছে তার নাম গারা গানচি তারা বসবাস করে বর্তমান আসামে। পরে এই গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করে কেউ বর্তমান বাংলাদেশে কেউ গভীর জঙ্গলে বর্তমান গারো হিলসে বসবাস করতে থাকে। এভাবে কেউ ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধি লিখে কেউ গারা গারাই গারে এভাবে বিভিন্ন উপাধি তুলে বা নেয় এভাবে আসল নাম থেকে একটু পরিবর্তন করে নেয় বলে। আবার গোত্র ভেদেও বিভিন্নতা দেখা যায়, যেমন আবেং বা আমবেং গোত্রের লোকেরা নিজেদের উপাধি ঘাগ্রা নিতে বা লিখতে বেশি পছন্দ করে, আদং গোত্রের লোকেরা আগে গারে গারাই নেয়। এখনো মাঝে মাঝে গারাই নিতে দেখি তবে বেশির ভাগ বর্তমানে আদং গোত্রেও ঘাগ্রা লিখতে বা নিতে দেখি, গারো হিলসে কাকড়া গারা গাবিল নিতে দেখেছি। অন্যান্য মাচং চাৎচি বা উপাধির মধ্যে এত বেশি পার্থক্য দেখা যায় না, যেমন আবেং গোত্রে ম্রং উপাধি হলে চিবক, দোওয়াল, আদং, আচিক গোত্রেও একই মাচং চাৎচি ম্রং দেখা যায়। যদিও ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধির মাঝে অনেক ভিন্নতা নাম দেখা যায়, কিন্তু তারা সবাই জানে আমরা এক চাৎচি মাহারি বা উপাধির লোক আলাদাভাবে কেউ চিন্তা করে না। ঘাগ্রা গারে গারা গারাই গাবিল এসব উপাধি রোমান হরফে জি দিয়ে শুরু করতে হয় তাই মেঘালয়ের গারোরা জি মোমিন লেখে। শুধু কাকড়া উপাধি ধারিরা কে মোমিন লেখে। বাংলাদেশের গারো ঘাগ্রাদের মোমিন লেখার অভ্যাস নেই কাউকেই লিখতে নিতে দেখি না, তাদের সংক্ষেপে জি লেখার দরকার পড়ে না, তারা সরাসরি নামের সাথে ঘাগ্রা গারে গারাই গাবিল লেখে। আগে হাজার হাজার বছর আগে তারা এক মায়ের এক আম্বির বা দাদীর গোষ্ঠী ছিল, সেটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে আবার ইদানীং আরো নিকটতম আত্মীয় জানার জন্যে ঘাগ্রার সাথে নতুন নাম জুরে দিয়েছে। যেমন—

১. ঘাগ্রা মাৎচি
২. ঘাগ্রা আব্রং
৩. ঘাগ্রা ররিন
৪. ঘাগ্রা মিকশ্রাম
৫. ঘাগ্রা সিমসাং
৬. ঘাগ্রা আচাপ
৭. ঘাগ্রা থেরিক বাংলায় কলাবাড়ি

ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধির সাথে এই নামগুলো এমনি এমনি আসে নি, নাম দেওয়া বা রাখার পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, ঘাগ্রা সিমসাং এই ঘাগ্রা উপাধির লোকেরা কেন সিমসাং সঙ্গে নিল তা বর্ণনা করলাম। সিমসাং একটি নদীর নাম। বর্তমান নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পাশে যে নদী বয়ে গেছে সেই নদীকে হাজার হাজার বছর আগে গারোরা সিমসাং নাম রেখেছে। পরে এই এলাকায় হিন্দু বাঙালিরা চলে আসে, গারোদের সাথে বসবাস করে, সুমেশ্বর পাঠক নামে এক বাঙালি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, পরে এই লোকের নামের সাথে মিল রেখে সুমেশ্বরী নাম হয়েছে বলে। একদল ঘাগ্রা মাচং চাৎচি এই সিমসাং নদীর পারে বসবাস করা শুরু করে বলে, অনেকদিন পরে এই ঘাগ্রারা তাদের মাচং চাৎচি বা উপাধির সাথে ঘাগ্রা সিমসাং লিখে বা রাখে। এভাবেই ঘাগ্রা সিমসাং গোষ্ঠী হয়ে যায়, পরে নাকি অনেক ঘাগ্রা সিমসাং ঘাগ্রা বাদ দিয়ে শুধু সিমসাং মাচং চাৎচি বা উপাধি লিখে নেয় বলে, এভাবে পরবর্তীতে তারাও আলাদা সিমসাং মাচং চাৎচি বা উপাধি হয়ে যায়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো হিলসে এই নদীর নাম সিমসাং নদী নামেই বর্তমানেও আছে, যে গ্রামের নাম সিমসাং গ্রী ছিল এখন আর সিমসাং গ্রী নেই উইলিয়াম নগর শহর হয়ে গেছে। মেঘালয় রাজ্যের অনেকগুলো জেলার মধ্যে উইলিয়াম নগরও একটি জেলা, এখন সিমসাং গ্রী বললে মানুষ আর চিনে না, নতুন নামের দাপদে শেষ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। ঘাগ্রা থেরিক বা কলাবাড়ি একদল ঘাগ্রা যে জায়গায় বসবাস করে, সেই জায়গায় প্রচুর থেরিক বা কলা গাছ ছিল, সেই কারণে তারাও নামের মাচং চাৎচি বা উপাধির পেছনে থেরিক বা কলাবাড়ি লিখে বলে। সিমসাং আসলে নদীর নাম অনুযায়ী, থেরিক বা কলাবাড়ি আসলে গাছের নাম অনুযায়ী হয়েছে। এভাবে নদীর নাম গাছের নাম অবস্থান বা স্থানের নাম অনুযায়ী উপাধির পেছনে জোড়া দেয় বলে। আর একটির ব্যাখ্যা দেই ঘাগ্রা মিকশ্রাম, এটার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অন্যরকম মিকশ্রাম মানে বাংলায় চোখের উপরের লোম, ইংরেজিতে যাকে আইব্রো বলে। একদল ঘাগ্রাদের চোখের উপরের লোম বা মিকশ্রাম খুবই সুন্দর কালো, একটু লম্বা, এই দলের ঘাগ্রাদের আইব্রো দেখতে অন্যান্য ঘাগ্রাদের চেয়ে অন্যরকম তাই তাদেরকে ঘাগ্রা মিকশ্রাম রেখেছে। ঘাগ্রা মাচং চাৎচি বা উপাধির এরকম নেওয়া মনে হয় একসময় প্রতিযোগিতার মতো হয়েছিল, একসময় এটা আর থাকে নি, শেষ হয়ে যায়, নতুন করে আর আসে নি, সব জায়গায় মানে না, শুধু মেঘালয়ের গারোদের মাঝে দেখা যায়। বাংলাদেশের ঘাগ্রাদের মাঝে এরকম নেওয়ার প্রচলন নেই গুরুত্বও নেই মনে হয়, শতভাগ ঘাগ্রারাই ঘাগ্রার সাথে আর একটি নাম যুক্ত আছে তা জানে না।

লেখাটি শেয়ার করুন...

Post a Comment

0 Comments