গারো মান্দি আচিক কোনটি জাতির নাম? ‖ তর্পণ ঘাগ্রা ‖ খু•রাং


জাতির পরিচয়ে একটি নাম থাকা উচিৎ। আগে থেকেই আমরা জেনে এসেছি জাতির নাম ‘গারো’ জাতি হিসেবে। এ নাম আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিত। এটাই মেনে নেওয়া উচিৎ বলে মনে করি। মাঝে মাঝে শিক্ষিত মানুষের মুখেও শুনা যায়, আমরা গারো জাতি নয়; আমরা মান্দি জাতি, বা, আচিক জাতি। এ ধরনের লোকের সংখ্যাও কম নয়। 

‘মান্দি’ শব্দটি আবেং গোত্রের ভাষা। আবেংরা ‘মান্দি’ বলে। এ শব্দকে চিবক ও দোয়াল গোত্রের লোকেরা মান্দায় বা মান্দাই বলে, আবার আচিক গোত্রের লোকেরা মান্দে বলে। এই আচিক গোত্রের ভাষাই গারোদের লেখ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই আচিক ভাষাতে বই হয়েছে, গল্প কবিতা হয়েছে, ডিকশনারী হয়েছে। এখনকার গারোরা এক গোত্রের ভাষা সংস্কৃতি আরেক গোত্রের গারোরা একেবারেই জানে না। জানার ইচ্ছেও নাই। তারা মনে করে, আমি আদং গোত্র, আমার ভাষা সংস্কৃতি আলাদা। প্রায় প্রত্যেকটি গোত্রেরই একই অবস্থা। কিন্তু প্রতিটি গোত্র সংস্কৃতি ঘুরে দেখলে বোঝা যায়, প্রায় সব কিছুই এক। মাঝে মাঝে দেখা যায় নাম আলাদা কিন্তু কর্ম এক। যেমন আদং গোত্র বলে চৌগান, আবেং গোত্র বলে মিমাং কাম। এখানে শুধু নামে পার্থক্য, কিন্তু কাজ কর্ম সম্পূর্ণ এক; কোন পার্থক্য নাই। আরো একটি বলি, যেমন মান্দি মান্দাই মান্দায় মান্দে আর কত পার্থক্য- শুধু একটু জোড়াতালি দিয়ে আমার করেছে। এটা নিয়ে কত কথা গারোদের মাঝে, বলে, আমারটাই ঠিক; বাকি গোত্রের বেঠিক। এভাবে মুখে অনেক অমিল দেখা যায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে সব মিল, কেউ তলিয়ে দেখে না।


আচিক গোত্রের ভাষায় মান্দে, এ শব্দের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মান + দে = মান্দে; ‘মান’ মানে মানুষ, আর ‘দে’ মানে সন্তান। অহম জাতি আর হাজং জাতিরাও মানুষকে মান বলে। মেঘালয়ের লেখক মিহির এন. সাংমা তার বই GIMAGIMIN A•CHIK RANGNI A•DOKRANG এখানে তিনি গারো জাত লেখেন নি, লিখেছেন আচিক জাত। তিনি লেখেন, অনেক আগে গারোরা নিজেদের পরিচয় দিত গারো মান্দাই হিসেবে, পরে মান্দাই বাদ দিয়ে গারো নামটি জাতির নাম হিসেবে রেখে দেয় বলে। এ গারো মান্দাইকে বাংলা করলে এরকম হয় ‘গারো মানুষের সন্তান’।

এখন প্রচলিত কথাগুলো একটু উদহরণ দেই—গারোরা কেউ বেশি খারাপ কাজ করলে এভাবে গালি-গালাস দেয় ‘নাআ মান্দেমা আচাক’ বাংলায় তুমি মানুষ নাকি কুকুর। এখানে মান্দি বা মান্দে শব্দের অর্থ মানুষ হিসেবে আসছে, এরকম আমরা অনেক বলতে পারি। যেমন ‘মিৎদেমা মান্দে’ বাংলায় দেবতা না মানুষ; মান্দেমা মাৎচু- মানুষ না গরু। এরকম অনেক শব্দ বের করা যায়, মান্দে বা মান্দি শব্দের অর্থ শুধু মানুষকে বোঝায়, কোন জাতিকে বোঝায় না। কিছু ব্যতিক্রমও আছে মান্দি শব্দের জাত হিসেবে ব্যবহার করাও পাওয়া যায়। যেমন মান্দিমা বাংগাল, বাংলায় গারো নাকি বাঙালি। এখানে মান্দি জাত হিসেবে আসছে, কিন্তু এটা শুধু গারোদের মধ্যেই সিমাবদ্ধ ভিন্ন জাতির সাথে আমরা সবসময় গারো জাতি হিসেবেই পরিচয় দেই।

গারো
গারো শব্দকে নিয়েও অনেকে অন্য কথা বলে। শত শত বছর ধরে জ্ঞানি-গুণি ব্যক্তিরা গারো শব্দকে নিয়ে গবেষণা করেছে, বই লিখেছে, বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছে। সেই গুণি গবেষকদের গবেষণার ফল ও বিভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরব। অনেক ব্যাখ্যা আছে সবগুলো সম্ভব নয়। আট-দশটি ব্যাখ্যা লিখছি। প্রথমে জবাং সাহেবের লেখা। জবাং সাহেবের আসল নাম জবাং ডি. মারাক, সে ব্রিটিশ সময়ে বি.এ. পাশ করেন। তাঁর ছেলে ডেনিসন সাংমা গারোদের মধ্যে প্রথম এম.এ. পাশ করেন। এ জবাং সাহেব গারো ইতিহাস বই লেখেন। তাঁর বইয়ে লেখা আছে গারোরা তিব্বেত থেকে এসেছে, তিব্বেতে তারা যে জায়গায় বসবাস করে তার নাম গারো প্রদেশ। সেই প্রদেশের নামানুযায়ী গারো জাতির নাম হয়। কিন্তু বর্তমান গবেষকরা অনেক পুরাতন ও নতুন ম্যাপ থেকে খুঁজে কোথাও গারো প্রদেশের নাম খুঁজে পায় নি। তাই তাঁর এ লেখা গ্রহণীয় হয় নি।


ব্রিটিশ শাসনামলে গারো এলাকায় একজন ইংরেজ ডেপুটি কমিশনার শাসন করে, তাঁর নাম মেজর A PLAYFAIR। তিনি গারোদের নিয়ে THE GAROS বই লেখেন। এ বইয়ে লেখা আছে তাঁর শাসনামলে দক্ষিণ অংশে যে গারোরা বসবাস করে তারা গারা গানচি গোত্রের লোক, পরে এ লোকেরা গানচি বাদ দিয়ে গারা থেকে গারো নেয়। এভাবে এ জাতির নাম গারো জাতি হয় বলে। কিন্তু বর্তমানে গারা গানচি গোত্রও আছে, শেষ হয়ে যায় নি। এখনও তারা গারা গানচি গোত্রই পরিচয় দেয়। এ কমিশনার গোহাতিতে থেকে তার শাসন কাজ চালাতো। গোহাতি বর্তমানে আসামের রাজধানী তার দক্ষিণ দিকে গারোরা এখনও বসবাস করছে। কিন্তু সেই সময়েও যারা অনেক দূরে যেমন তুরা বাঘমারা এলাকাতেও যে গারোরা বসবাস করত তারাও নিজেদেরকে গারো জাতি হিসেবেই পরিচয় দিত। এ কারণে এ ডেপুটি কমিশনারের লেখাও গারোরা মেনে নেয় নি। যুক্তি সংগত মনে করে নি।

লেখক P. C. DHAR তাঁর বইয়ে লেখেন বর্তমান পশ্চিম বঙ্গে মালদা শহরে গৌড় নামক জায়গায় গারোরা শত শত বছর থেকে বসবাস করেছিল বলে। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাকি পাওয়া গেছে, তারা বলেছে CHING•A GAURRANG বাংলায় আমরা গৌড় জাতি। এ GAUR থেকে নাকি পরে GARO জাতি হয়ে যায়। তাঁর এ লেখাকেও বর্তমান গারো গবেষকরা মেনে নেয় নি তারা বলে গৌড়ে গারোরা বসবাস করেছে, সে সময় কুচ বিহার, গোয়ালপাড়া, তুরাতেও গারোরা বসবাস করেছে, তারা নিজেদেরকে কিভাবে গৌড় থেকে গারো জাতি পরিচয় দেয়।

লেখক R. M. NATH তাঁর বই THE BACKGROUND OF ASSAMESE CULTURE বইয়ে লেখেন গারোরা U. P. বা উত্তর প্রদেশ রাজ্যে GARHWAL নামক জায়গায় দীর্ঘদিন বসবাস করে। সেখানে তারা ভালভাবেই ঘর সংসার করে ফসল ফলায়, সারা বছর সুখে-শান্তিতে থাকে, অনেকে ধনী হয়ে যায়, যখন U. P. তে দুর্ভিক্ষ মহামারি আসে তখন তারা U. P. ছেড়ে চলে যায় বলে। GARHWAL জায়গায় থাকার সময় তারা নিজেদের GARHWAL জাতি বলে পরিচয় দেয়, সেই GARHWAL থেকে নাকি পরবর্তীতে GARO হয়ে যায়। GARHWAL জায়গার গারোরা নিজেদেরকে যদি GARO বলে পরিচয় দেয়, অন্যান্য জায়গাতেও গারোরা বসবাস করেছে, তারাও নিজেদেরকে GARO পরিচয় দিয়েছে। তাঁর এ লেখাও যুক্তি সংগত হয় নি, তাই গারোরা মেনে নেয় নি।

আবার কিছু কিছু শোনা যায় ধুমদাম যুক্তি COOH BEHAR রাজ্যে গারোরা চারশত বছর বসবাস করে, তখন সেখানে কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বি লোক ছিল না, সব হিন্দু ধর্মের লোক। গারোরা আগে থেকেই গরুর মাংশ পছন্দ করে, খায়, আবার পাশের জাতি হিন্দুরা গরু পূজো দেয়, এ কারণে রাগ করে তারা গরু খাওয়া জাতি বলে। এ গরু খাওয়া জাতি থেকে নাকি পরে গরু শব্দ পরিবর্তন হয়ে গারো জাতি হয়ে যায়।

অন্যরকম কথাও আবার শোনা যায়, অন্যান্য জাতির তুলনায় গারো জাতিরা নাকি অনেক পরে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়, শিক্ষিত অন্যান্য জাতিরা অশিক্ষিত গারোদের সাথে কথা বলে মজা পেত না। শিক্ষিত লোকদের কথা তারা বুঝত না, তাই শিক্ষিত জাতিরা গারোদেরকে গাধা গরু জাত বলে গালি গালাস দিত। পরে গাধা শব্দটি বাদ দিয়ে গরু থেকে গারো জাতি হয়ে যায় বলে।

বর্তমান বাংলাদেশের গারোরাও গারো জাতির শব্দের ইতিহাস নিজেদের মতো তৈরি করে নিয়েছে। আমি অনেক বয়স্ক লোকের কাজ থেকে নিজের কানে শুনেছি, তারা বলে, গারো শব্দটি গারোদের দেওয়া নাম নয়, এটা বাঙালিদের দেওয়া নাম বলে। তাদের কথা, গারোরা জাতিগতভাবে ঘাড় শক্ত ঘাড় তেরা, তারা যেটা বোঝে সেটাই নাকি ধরে থাকে অন্যদের কথা আর বুঝতে চায় না। এ গাওরামি করার জন্যে নাকি বাঙালিরা গারওয়া জাতি নাম দিয়েছে, পরে গারওয়া থেকে পরিবর্তন হয়ে গারো জাতি হয়ে যায়। নিজেদের জাতির নাম নিজেদের জিনিস হারিয়ে ফেললে যা হয় একটা কিছু আবল-তাবল যুক্তি দেখিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, আজ গারোদেরও দেখি এ অবস্থা হয়েছে।

আরো একটি খুব পুরোনো কাহিনী শোনা যায়, হিন্দুদের মহাভারত পবিত্র গ্রন্থে গুরুর পাখির নাম উল্লেখ আছে, এ গুরুর পাখিকে চটাই পাখিও বলা হয়। এ পাখি খুব শক্তিশালী রাক্ষস দানব। গারোরা এ পাখির নাম দিয়েছে স্কাল দওরেং নকথিব বা দওরেং গাকগাগি, বাংলায় রাক্ষস ঈগল পাখি। এ ঈগল পাখি নাকি রিবাট বড় আর প্রচুর খেতে পারে। সে জঙ্গল পাহাড় পর্বত দিয়ে উড়ে গেলে সামনে বাঘ ভালুক হাতি যা দেখে যা পায় সব নাকি ধরে গিলে খায়। একটি হাতিতে নাকি তার পেট ভরে না, চার-পাঁচটি হাতি খেতে হয়। রাক্ষস ঈগল- যে জঙ্গলে পাহাড়ে গারোরা বসবাস করে, সেই গ্রাম এলাকায় মাঝে মাঝে হানা দিয়ে মানুষ গরু ছাগল মহিষ যা সামনে পায় খেয়ে সাবাড় করে দেয় বলে। গ্রামে এলাকায় গারোদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে যায়। গারো নকমা বা রাজা বলে, আরও লড়াই করে দেখি, যদি হেরে যায় তবে এ জায়গা গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। নকমা বা রাজা আদেশ করে বীর যুবকদের, তোমরা তীর ধনু ঠিক করো, যার ধনু সবচেয়ে মজবুত হবে, তাকেই মারতে হবে রাক্ষস গুরুর পাখিকে। বীর বুগা জাচাং ডিককা রেংরাপের ধনু নাকি সবচেয়ে মজবুত। রাজা বীর বুগা জাচাং ডিককা রেংরাপকেই আদেশ দেয় রাক্ষস গুরুর পাখিকে মারার। তার উপাধি বা মাচং চাৎচি রাংসা মারাক। সে পাখির দুর্বল দিক দেখে, প্রতিদিন পাখি ঠিক দুপুরের সময় চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। সে চোখে ভাল দেখে না, তাই তার ছেলেকে পিঠে তুলে কাপড়ে বেঁধে নিয়ে যায়, গারোরা বলে বাথমমে বিসাথাংকো রিমমাংআ। বাবা ছেলে বন জঙ্গল ভেঙে যেতে থাকে হঠাৎ তার ছেলে দেখে বিরাট বড় গাছের ডালে বসে রাক্ষস ঘুমাচ্ছে। ছেলের বলার সাথে সাথে বাবা তীর ধনু টার্গেট করে, কারণ বিশ্বাস নেই কখন রাক্ষস উড়ে এসে বাবা ছেলেকে গিলে ফেলে। ছেলে তীরের টার্গেট ঠিক করে দেয়। বাবাকে বলে, হয় নি, আরেকটু উপরে। এবার টেনে তীর ছেড়ে দাও। সঙ্গে সঙ্গে বাবা ধনু জোরে টেনে তীর ছুড়ে দেয়। তীর রাক্ষস গুরুর পাখির বুকে আঘাত করে। আস্তে আস্তে বিরাট বড় দেহ নিয়ে মাটিতে পড়ে যায়, বাবার চোখ খারাপ তাই দেখে নি, কিন্তু ছেলে পিঠের ওপর থেকেই দেখেছে। ছেলের উপাধি মাচং মাহারি স্নাল সাংমা, সে পিঠের ওপর থেকেই চিৎকার দিয়ে বলে ‘খা সাংমা, রাক্ষস গুরুর পাখি মারা গেছে বলে গ্রিকগা বা হুংকার দেয়। এটা নিয়ে সাংমা মারাকের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়, কে মেরেছে সাংমা নাকি মারাক? যা হোক, এ নিয়ে আর এগোতে চাই না। এ গুরুর পাখিকে মেরে গারোরা সে জায়গায় বসবাস করে পরে তারা নিজেদেরকে গুরুর নাম অনুযায়ী গুরুর জাত বলে পরিচয় দেয়, এ গুরুর শব্দ থেকে পরবর্তীতে গারো হয়ে যায় বলে। অনেক উদাহরণ দিয়েছি আরো দিতে পারতাম, কিন্তু আর প্রয়োজন নেই, প্রিয় গারোরা, এখন দেখুন আমরা নিজের জাতির নাম ইতিহাস হারিয়ে ফেলে কিভাবে বিচ্ছিন্নভাবে ইতিহাস যোগাড় করে বেঁচে থাকতে চায়। এখন আসল ইতিহাস সম্পর্কে বলি।

লেখক গবেষক P. C. BHATACHARJEE তাঁর বই NOTES ON BORO GARO AND SHAN এখানে তিনি গারো সম্পর্কে যুক্তি সংগত লেখা লেখেন, তিনি লেখেন, GARO শব্দ BORO ভাষা থেকে এসেছে। BORO ভাষায় গারো শব্দের অর্থ WA•TANGA বা ফেলে চলে যাওয়া। ভাই বোনদের ফেলে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। যেমন এখনো গারোরা যায়। পরে DR. ROBINS BURLING ও P. C. BHATACHARJEE একত্রে THE LEXICO STATISTICAL DATTING ANALYSIS বইয়ে লেখেন এক সময় GARO BORO একই ভাষায় কথা বলত। এখনও ভাষার শব্দে প্রায় মিল আছে তারা একসময় একই জাতি ছিল, পরে আস্তে আস্তে প্রথম MILLINNIUM B. C. এ সময়েই আলাদা হয়ে যায় বলে। GARO BORO এবং SHAN জাতি BORO জাতি থেকে বের হয়ে এসেছে, তারা সবাই BODO ভাষায় কথা বলে TIBETO BURMAN ভাষার অন্তর্ভুক্ত জাতির মানুষ।

কুচ বিহার রাজ্যের রাংঙ্গামাটি জায়গা থেকে দুই বোন আলাদা হয়ে যায়, বড় বোনের নাম NAMBAE, এ নামবায় গারোদের সবচেয়ে পুরোনো আম্বি বা দাদীমা। ছোট বোনের নাম SIMBAE। নামবায় তার দলবল নিয়ে কুচ বিহারের রাংঙ্গামাটি থেকে চলে আসে বা গারো ভাষায় WA•TANGA। ছোট বোন সিমবায় রাংঙ্গামাটিতেই থেকে যায়, তাদেরকেই বলা হয় বামন রাচা সজন গিদেল বা BORO KACHARI জাতির দল। সিমবায় BORO KACHARI জাতির সবচেয়ে পুরোনো আম্বি বা দাদীমা, সিমবায়ের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী ও তার দলের লোকেরা নামবায়ের বংশধরদের GARTO বলে ডাকে। এ গারো শব্দের অর্থ WA•TANGA ফেলে চলে যাওয়া, তখন থেকে নামবায়ের দলের লোকেরা গারো জাতি হয়ে যায়। এ নাম ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল আর বর্তমান গারোরা গ্রহণ করে নিয়েছে।

আচিক
আমি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রায় ৬-৭ বছর ভিসা নিয়ে মেঘালয়ে বছরে দুই-তিনবার যাওয়া আসা করতাম। উদ্দেশ্য ছিল ব্রাদার গিয়োমের মাধ্যমে বাংলাদেশের গারোদের আচিক ভাষা শিক্ষা প্রচলন করা। তখন ৭০টি স্কুলে গারোদের লেখ্য ভাষা আচিক শিখাতাম। আচিক ভাষা আমিও জানতাম না। তাই ব্রাদার গিয়োমের সাহায্যে ভাষা শিখতে যেতাম। আচিক গারোদের একটি গোত্রের নাম। আচিক শব্দের অর্থ আ•চুওয়া বা পাহাড় পর্বত। পাহাড় পর্বতকে গারোরা আব্রিও বলে। এ পাহাড়ে যারা বসবাস করে তাদেরকেই আচিক বলে। মেঘালয় রাজ্যে গারোদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বসবাস। সেখানে গিয়ে দেখি শুনি মান্দি শব্দ নাই, খুঁজে পাওয়া যায় না, তারা বেশিরভাগ বলে আমরা আচিক। বাংলাদেশের গারোরা চিৎকার দিয়ে কেউ কেউ বলে আমরা গারো নয় আমরা মান্দি। মেঘালয়ে গিয়ে আর একটি চিৎকার শুনতে পেলাম তারা বলে আমরা গারো নয় আমরা আচিক জাতি।


একটি কাহিনীর কথা তুলে ধরি। আমি একসময় উইলিয়ামনগর শহরে ছিলাম। সেখানে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রায় দুইশত লোকের সমাগম হয়েছিল। আমি বাংলাদেশের গারো তাই আমাকে বক্তব্য দিতে সুযোগ দিল। আমি কথা প্রসঙ্গে বললাম, আমরা গারো জাতি সঙ্গে সঙ্গে একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে বলে, না-না, আমরা গারো জাতি নয়, আমরা আচিক জাতি।

এখন দেখুন গারো যুবক-যুবতীরা আমরা এ জায়গায় কী চিৎকার শুনতে পায়! কোনটা মেনে নেব, কোনটা ফেলে দেব, এ চিৎকার এখন থেকে নয়, প্রায় এক দুই পুরুষ চলে গেছে। আজও গারো জাতির নাম এক ইঞ্চিও নড়চড় করতে পারে নাই। জানি না ভবিষ্যতে নড়চড় করতে পারবে কিনা? নাকি চিৎকার দিয়েই থাকবে।

আচিক শব্দের ভাল শ্রুতিমধুর ইতিহাস বাস্তব কাহিনী আছে তাই তারা আমরা আচিক জাতি বলে চিৎকার করে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে গারোদের মাচং চাৎচি বা উপাধি বের হয়েছে কিন্তু কোন নিয়ম নীতি ছিল না, একজন অপরজনের সাথে সবসময় ঝগড়া-ঝাটি করে, বিশেষ করে সাংমা মারাকেরা। সাংমা গোষ্ঠী সবসময় আলাদা থাকত, মারাকদের সাথে মিশতো না, বিবাহের সময়ও সাংমা সাংমাকেই বিয়ে করে মারাককে বিয়ে করত না। মারাকদেরও একই অবস্থা। মারাক গারোকে অন্য জাতি আক্রমণ করলে সাংমা গারোরা সাহায্য সহযোগিতা করত না, বরং ধ্বংস করে ফেলার, মেরে ফেলার চিন্তা-ভাবনা করেছিল। গারো জাতি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিল। নকমা রাজিপা গভীরভাবে চিন্তা করে, এভাবে চললে গারো জাতি পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যাবে আর তার অস্তিত্বই থাকবে না, পৃথিবী থেকে গারো জাতি হারিয়ে যাবে। সে প্রত্যেক নকমার কাছে যায়, পরামর্শ করে, নিয়ম কানুন তৈরি করতে চায় গারোদের একত্র করতে চায়, গারো সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায়। সব নকমার অনুমতি নিয়ে নকমা রাজিপা গারোদেরকে নিয়ে বড় মেলা মিটিং করে গারোদের নিয়ম কানুন ঠিক করে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে। সাংমা সাংমাকে বিয়ে করতে পারবে না, সাংমা মারাককে বিয়ে করতে হবে, এতে সাংমা মারাকের আত্মীয়তা আসবে, বিপদ-আপদ আসলে একে-অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। মারাককেও একই নিয়ম দেয়, আবার চিসিম সাংমা যদি চিসিম ছেলে চিসিম মেয়েকে বিয়ে করে সেটাকে বলব ‘মাদং’। কোন যুবক যুবতী মাদং হলে তাদের একমাত্র বিচার হবে মৃত্যুদন্ড বা মেরে ফেলা। আবার চিসিম সাংমা স্নাল সাংমা যুবক-যুবতী যদি বিয়ে করে সেটা হবে বাকদং, তাদেরকেও বিচার করা হবে, তাদের মেরে ফেলা হবে না, কিন্তু গারো এলাকা গ্রাম থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর বোনের সবচেয়ে ছোট মেয়ে গারোরা বলে ‘সা•চন’ আর ভাইয়ের সবচেয়ে বড় ছেলে গারোরা বলে ‘সকচি’কে বোন নকক্রম বা নকক্রং জামাই আনবে, সেই শ্বশুর শাশুড়িকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখবে। এরকম প্রচুর নিয়ম সে তৈরি করে। সবকিছু বলার পর সে জিজ্ঞেস করে এ নিয়ম তোমাদের ভাললাগে কিনা, তারা সবাই বলে, এ নিয়ম পালন করলে গারোরা আবার একত্রিত হবে, একতা ফিরে আসবে। গারোদের আবার আগে থেকেই নিয়ম আছে শুধু মুখে ভাল বললেই হবে না, গারো ভাষায় মিকচেৎদা বা শপথ নিতে হয়, শপথ না নিয়ে মুখের কথার কোন দাম নেই। নকমা রাজিপা নিজে এক মুঠো মাটি হাতে নেয়। সবাইকে নিতে বলে। তারপর মাটি কামর দিয়ে শপথ নেয়, গারো ভাষায় আআকো চিকগে মিকচেৎদা। ‘আ’ মানে মাটি, ‘চিকগা’ মানে কামর দেওয়া। আ + চিকগা = আচিকগা বা আচিক। এভাবে ঐতিহাসিকভাবে আচিক শব্দটি গারোদের মধ্যে চলে আসে। তাই অনেকে বলে আমরা মাটি কামর দিয়ে শপথ নিয়ে একতাবদ্ধ হয়েছি পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছি, তাই আমরা এখন গারো নয় আমরা হয়ে গেছি আচিক। কি মনে করেন প্রিয় গারো পাঠকবৃন্দ যারা গারো জাতিকে বাদ দিয়ে আচিক জাতি বলে বুকে লালন পালন করে বেঁচে আছে তাদেরকেও আপনি কোথায় ঠেলে ফেলে দেবেন। বর্তমানে গারো জাতির নামের সংকটের সময় আর একজন নকমা রাজিপার খুব জরুরি দরকার ছিল, কেউ এগিয়ে আসবেন কি?
তর্পণ ঘাগ্রা: লেখক, গবেষক, সমাজকর্মী।

Post a Comment

1 Comments

  1. It's good to learn about it but, since we are acquainted with garo, achik, mandi we should at least take a name and it's nothing but garo to introduce to others though we introduce ourselves among us as achik or mande. We need to pay heed to it.Thanks. Lintu Areng, omi

    ReplyDelete