কর্মী থেকে উদ্যোক্তা ফ্রান্সিলা নকরেক ‖ ওয়েলসন নকরেক ‖ খু•রাং

ছিলেন কর্মীহয়ে গেলেন উদ্যোক্তা।

পথ বন্ধ হওয়া মানেই যে সব শেষ হওয়া নয়। এর মানে যে নতুন পথের শুরু। সেই পথটাকে সন্ধান করতে হয় মাত্র। সমাপ্তি মানে যে নতুনের সুত্রপাত। একটি বাক্য শেষ হওয়া মানেই যে আরেকটি নতুন বাক্যের শুরু। এ কথাগুলো যার ক্ষেত্রে কাটে তিনি ফ্রান্সিলা নকরেক। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার বেদুরিয়া গ্রামে। ফ্রান্সিলা নকরেক একজন উদ্যোক্তা। এর আগে তিনি ছিলেন তাঁত বস্ত্র বয়ন শিল্পী মানে কর্মী। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে তার কর্মস্থল 'মিচিকনি জুমাং তাঁত শিল্প' বন্ধ হয়ে যায়। এর পরই তার নতুন যাত্রা শুরু হয়। গত ২০ মার্চ তার নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান 'নকরেকনি জুমাং তাঁত শিল্প' তিনি চালু করেন

ফ্রান্সিলা নকরেক। ছবি : রিচার্ড দফো

ফ্রান্সিলা উদ্যোক্তা হিসেবে একেবারে নবীন হলেও উৎপাদন বিপননে মোটেও নতুন নয়। এক্ষেত্রে তার রয়েছে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা। করোনা ভাইরাসের কারণে কারখানাসহ অফিস বন্ধ থাকায় ১৩ এপ্রিল সোমবার তার বাড়িতে বসেই শেয়ার করেছেন সেই অভিজ্ঞতা।

অষ্টম শ্রেণীর পর দারিদ্র্যের কারণে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি ফ্রান্সিলা নকরেকের।সময়টা ১৯৯০। একদিন সুযোগ এলো 'আইডিআস' নামে এক সংস্থার অধীনে তাঁত বস্ত্র বুননের প্রশিক্ষণ নেওয়ার। এর পরিচালক ছিলেন কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক কারিতাস বাংলাদেশের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলবার্ট মানখিন। ফ্রান্সিলা চলে গেলেন ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলিতে। সংস্থার খরচে থাকা-খাওয়া আর তেল-সাবান। কোনো ভাতা নাই। কথা ছিল প্রশিক্ষণ হবে মাসের। কিন্তু চিকন সুতার কাজ শিখতে তার লেগে গেল মাস। 

প্রশিক্ষণ শেষে পার্শ্ববর্তী সাধুপাড়া গ্রামে একই সংস্থার দ্বারা পরিচালিত তাঁতের কারখানায় ১৯৯১ সালে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। বেতন সাকুল্যে ৯৫০ টাকা। সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর উৎপাদন শুরু। সেই সময়ে তারা এক্সপোরটেবল বিছানার চাদর বুনতেন। একটা চাদর দুইজনে মিলে বুনতেন। প্রতিটি চাদরের জন্য একজন পেতেন ৫০ টাকা করে। একদিনে সর্বোচ্চ ২টা চাদর বুনতে পারতেন। কিন্তু কারখানাটি ১৯৯৬ সালে এসে বন্ধ হয়ে গেল। এর মধ্যে একদিন তিনি পীরগাছা ধর্মপল্লীর তৎকালীন পাল পুরোহিত ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি সাথে দেখা করতে গেলেন। আর উপহার হিসেবে নিয়ে গেলেন তার বুনা বিছানার চাদর। উপহার পেয়ে খুশি হয়ে তার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ফ্রান্সিলা সবিস্তারে বললেন। ফাদার হোমরিক তাকে জানালেন তিনিও তাঁত কারখানা স্থাপন করতে চান এবং তিনি সেই তাঁতে কাজ করার জন্য ফ্রান্সিলাকে প্রস্তাব করলেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করে নাম লিখিয়ে আসলেন।

পরের গল্প ধৈর্য আর একনিষ্ঠতার। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ফাদার হোমরিক 'মিচিকনি জুমাং তাঁত শিল্প' স্থাপন করলেন। ফ্রান্সিলা মিচিকনি জুমাং-এ যোগ দিলেন। সহকর্মীরা মোটামুটি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমিই সেই ফ্রাসিলা! তুমি নাকি আমাদের ট্রেইনার হয়বা? কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। টাঙ্গাইল থেকে মোস্তফা নামে একজনকে ট্রেইনার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। যা হোক, আগে থেকে কাজ জানা থাকাই ফ্রান্সিলার নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হলো না। তিনি সরাসরি উৎপাদনে লেগে গেলেন। ফাদার হোমরিক পীরগাছাতেই থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু সুবিধা বেশিদিন ভোগ করতে পারলেন না। পরের বছর থেকেই বাড়ি থেকে যাতায়াত করে ডিউটি করতে হলো। এর মধ্যে বড় মেয়ের বয়স প্রায় এক বছর। মেয়েকে ছোট বোনের কাছে রেখে ডিউটি করতেন। কিলোমিটার পথ, তার মধ্যে কিলোমিটার আবার বনপথ। সে সময়ে মানুষের যাতায়াতও কম। রাস্তার দুই পাশে ঘন ঝোপঝাড়। ভয় হতো তাই তিনি স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যেতেন। বছর এই কষ্ট করলেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এসে সুদে টাকা ধার নিয়ে একটা সাইকেল কিনলেন। ছোট ছেলের বয়স তখন মাস। ছেলেকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে যাতায়াত করতেন। ফ্রান্সিলা নকরেক বলেন, ‘বাবু যেন ঘুমিয়ে না পরে সে জন্য গল্প বলে বলে জাগিয়ে রাখতাম। তবু মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ত। একদিন এমনি করে পরে যাচ্ছিল।এমনি করেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে মেয়েকে অনার্স শেষ করালেন।

নকরেকনি জুমাং তাাঁত শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারাখানা। ছবি : রিচার্ড দফো

 
২০১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পীরগাছা ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত তাঁত বন্ধ করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে ৪০০ সেটের একটা অর্ডার পেলেন ফ্রান্সিলা। এভাবে ২০২০ পর্যন্ত টেনে আনলেন। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে মিচিকনি জুমাং বন্ধ হয়ে গেল। এর মধ্যে তিনি স্থানীয় একটি ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেন। তার নিজের সঞ্চয় এবং ঋণের টাকা দিয়ে পীরগাছায় গড়ে তুলেন নকরেকনি জুমাং তাঁত শিল্প কারখানার কাছেই একটা আউটলেটও খুলেন। আগের কর্মস্থলে তারা দকসারি, গামছা, ওড়নারুমাল, ফতুয়া তৈরি করতেন। ১০০% সূতির হওয়ার কারণে তাদের বুনা কাপড়ের চাহিদা ছিল। এখনো সেই একই মান বজায় রেখেছেন। এখন তার তাঁতে জন কর্মী কাজ করছেন। তাঁতের কল কেনা, এনে বসানো থেকে শুরু করে নানা কাজে স্বামী সুজনের সহযোগিতার কথা স্বীকার করেন।

ভবিষ্যতে তিনি নিজ গ্রামেও তাঁত বসাতে চান। তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষ যদি কাজ করতে চায় তাহলে ভবিষ্যতে গ্রামেও কারখানা বসাব।ভবিষ্যতে তার উৎপাদিত পণ্যের সুনাম এলাকার গন্ডি পেরিয়ে বাইরেও পৌঁছে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা ফ্রান্সিলা নকরেকের।

লেখাটি শেয়ার করুন...

Post a Comment

0 Comments